মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান (৭-১২- ২০২৩)
হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালের আরব - ইসরাইল যুদ্ধ এবং সৌদি আরবের নেতৃত্বে তেল উৎপাদন কারী আরব দেশগুলো যুদ্ধে ইসরাইলকে সাহায্য কারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , পশ্চিমা দেশ এবং জাপানের বিরুদ্ধে জ্বালানি তেল বিক্রি ও সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সৌদি সহ তেল রপ্তানি কারী আরব দেশগুলোর সাথে দ্রুত আলোচনা চালালে কিছু দিনের মধ্যে উক্ত অবরোধ উঠিয়ে নেয় আরব দেশগুলো যার ফলে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির চাপ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং জাপানের অর্থনীতির ওপর স্বল্প কালীন হলেও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল তা থেকে উদ্ধার পায় ।
হেনরি কিসিঞ্জার তখন ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এক নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা মূলক কূটনীতি প্রবর্তন করেছিল যা ৫০ বছর স্থায়ী হয়েছিল । কিন্তু গত ৭-১০-২০২৩ তূফানুল আকসা অভিযান শুরু হলে কিসিঞ্জারের উক্ত নিরাপত্তা - প্রতিরক্ষা মূলক পরিকল্পনা ও কূটনীতি সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়েছে ও ভেস্তে গেছে। ইসরাইল তীব্র অস্তিত্ব সংকটে আপতিত হয়েছে।
আসলে ইসরাইল গোটা দেশ ও জাতি নয় হামাসের মতো একটা সংগঠনের অভিযানে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং ৪৮ ঘন্টা যাবৎ সম্পূর্ণ এলোমেলো বিশৃঙ্খল হয়ে ছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জরুরি ভিত্তিতে অতি দ্রুত এসে ইসরাইলের সার্বিক তত্ত্বাবধানের হাল ধরতে বাধ্য হয় । আর এটা না করলে ইসরাইল সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ত এই হামাস নামক এক সংগঠনের হাতে । আর এটা করতে যেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ওপর চাপ বিশেষ করে এনার্জি প্রেসার ( জ্বালানি জনিত চাপ ) অনেক বেড়ে যাবে ।
৭ অক্টোবর ২০২৩ তূফানুল আকসা অভিযানের পরিণতিতে ঐ অভিযানের দুএক দিনের মধ্যেই ইসরাইলের শেয়ার মার্কেটের ক্ষতি ২০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে !!! আর এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা ইসরাইলের শেয়ার মার্কেটের জন্য আর সহনীয় থাকবে না ।
এ ছাড়াও তূফানুল আকসার ১ম ৭ দিনে ইসরাইলের অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষয় ক্ষতি ছিল ৩০ বিলিয়ন শেকেল যা প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার।
এরপর বলা হয় প্রতিদিন ইসরাইলের আর্থিক ক্ষতি ২৬০ মিলিয়ন ডলার। যখন গাযায় ইসরাইল স্থল যুদ্ধ শুরু করে তখন থেকে প্রতিদিন যুদ্ধের খরচ ৬০০ মিলিয়ন ডলার হচ্ছে । বলা হচ্ছে যে গাযায় ইসরাইলের যুদ্ধ খরচ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
কিন্তু এখন নতুন করে বলা হচ্ছে যে যুদ্ধে প্রতিদিনের খরচ ২ বিলিয়ন ডলার !!! আসলে প্রকৃত খরচ যে কত হচ্ছে তা বলছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নাকি ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করলেই শেষ হয়ে যাবে । কিন্তু যুদ্ধ শেষে বলা হয় ১ট্রিলিয়ন ডলারের ওপর খরচ হয়েছে অথচ ট্রাম্পের শাসনামলে প্রকাশ পায় যে ইরাক যুদ্ধের প্রকৃত খরচ আসলে ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক হয়েছিল !! এখন গাযায় ইসরাইলের আগ্রাসী যুদ্ধের খরচও ঠিক ইরাক যুদ্ধের খরচের মতোই হতে যাচ্ছে। কারণ এটা ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ । আর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তো এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেই হবে!!!
এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এ যুদ্ধে যে সে সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যুদ্ধের খরচের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে না । আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ইসরাইলের যুদ্ধ নীতি ও যুদ্ধ পুরোপুরি সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও যন্ত্র নির্ভর অথচ হামাসের যুদ্ধ নীতি ও যুদ্ধ হচ্ছে তদবীর ( সুক্ষ্ম সামরিক পরিকল্পনা ) নির্ভর যাতে সীমিত অস্ত্রের সুক্ষ্ম ও কার্যকর ব্যবহার সুনিশ্চিত হয় । ইসরাইল চলমান এ যুদ্ধে গাযার মতো ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের ২০০০০ পয়েন্টে বোমাবর্ষণ করেছে !!! এক রকম লক্ষ্য বিহীন কানা আন্দা গোন্দা আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এ ধরণের বোমাবর্ষণে অগণিত বেসামরিক লোকজনের হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে । আর ইসরাইল এ ধরণের উন্মাদনা ময় হামলা চালিয়ে তার ঘোষিত লক্ষ্যগুলোও অর্জন করতে পারছে না । এমন তাণ্ডব বেধড়ক এলোপাথাড়ি বোমা ও গোলাবর্ষণের বিপুল পরিমাণ খরচ তো আছেই।
যুদ্ধের খরচ মেটাতে এখন ইসরাইলের পুরো অর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে যুদ্ধ কালীন অর্থনীতিতে। যুদ্ধের আগে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ২৩•৪ বিলিয়ন ডলার ( ২০২২ সালে ) । ইসরাইলের ৮০% ভাগ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক ফুড করিডোর ( যা ভারতের মুম্বাই থেকে আরব আমিরাত - সৌদি আরব - জর্দান - উত্তর গাযা - ইসরাইলের হাইফা বন্দর পর্যন্ত হবে ) এখন এ যুদ্ধের কারণে অনিশ্চিত। এ যুদ্ধের কারণে ইসরাইলের পর্যটন শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। শীত মৌসুম ইসরাইলের পর্যটন মৌসুম। কিন্তু যুদ্ধ চলার জন্য বিদেশি পর্যটকদের ইসরাইল সফর এখন বন্ধ । এটাও ইসরাইলের অর্থনীতির ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে।
ইসরাইলে কর্মরত বিদেশি হাইটেক প্রতিষ্ঠান সমূহের অনেক গুলো বন্ধ করে চলে গেছে ও যাচ্ছে । মাইক্রোসফট হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে যে এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইসরাইলের প্রযুক্তি ভবিষ্যত অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়বে।
অনেক দক্ষ জনশক্তিও ইসরাইল ছেড়ে চলে গেছে ও যাচ্ছে । এ যুদ্ধের কারণে ইসরাইলে বেকারত্ব ৩•৮% থেকে বেড়ে আগামী বছর ৪•৫ % - এ দাঁড়াবে। আর যুদ্ধের খরচ যত বাড়বে ইসরাইলের বাজেট ঘাটতিও তত বাড়বে এবং সেই সাথে তাল দিয়ে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা তীব্রতর হলে ইসরাইলে জনরোষ ও গণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে। ৭ অক্টোবরের তূফানুল আকসা ইসরাইলের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার ওপর মরণ আঘাত হেনেছে। আর এ সব কারণে ইসরাইল থেকে বহু ইসরাইলী নাগরিক সে দেশ ত্যাগ করছে যাদেরকে ইসরাইলের দ্রুত উন্নয়ন ও বর্ধন শীল অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইসরাইলে আনা হয়েছিল।
ইসরাইলের ৪০% বৈদেশিক বাণিজ্য বাবুল মান্দাব প্রণালী দিয়ে হয়ে থাকে। কিন্তু গাযায় ইসরাইলের বর্বর নির্মম নৃশংস আগ্রাসন ও গণহত্যার প্রতিবাদে ইয়েমেন লোহিত সাগর ও বাবুল মান্দাবে ইসরাইলী বাণিজ্যিক জাহাজ এবং যে সব জাহাজ ইসরাইল অভিমুখে আসা যাওয়া করে সেগুলো জব্দ বা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। এতে করে বীমা সংক্রান্ত খরচ অত্যন্ত বেড়ে যাবে এবং আরব সাগর - বাবুল মান্দাব প্রণালী - লোহিত সাগর ( এই সামুদ্রিক বাণিজ্যিক পথ বা রুট ) যদি ইয়েমেনের কারণে ইসরাইলের জন্য অনিরাপদ হয় এবং সে ক্ষেত্রে যদি ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য ইসরাইলী জাহাজ এবং ইসরাইলে যাতায়াতকারী বিদেশি জাহাজ গুলো পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে ও চক্কর দিতে বাধ্য হয় তাহলে সময় বেশি লাগবে এবং সার্বিক পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে । আর এরফলে ইসরাইলের আমদানি রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে । অবশ্যই ইয়েমেনের সাহসী বৈপ্লবিক এ উদ্যোগ যা আসলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ তা গাযায় ইসরাইলের আগ্রাসী যুদ্ধের ওপর প্রভাব ফেলবে । আসলে ইয়েমেনের মতো অন্য সকল মুসলিম দেশ এ ধরণের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করত তাহলে ইসরাইল গাযায় আগ্রাসন , হত্যাযজ্ঞ ও নাহক যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হত । কিন্তু মুসলিম ও আরব দেশ গুলোর সরকার সমূহ এ সব উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিচ্ছে না ।
ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেনা ২০২৩ সালের মে মাসেই ৪০০বিলিয়ন ইউরো ছাড়িয়ে গেছে এবং ইউক্রেনকে সমর্থন , সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য এই ধার - কর্যঋণ বা দেনা ভারী হওয়ার এক অন্যতম কারণ। এখন এর সাথে যুক্ত হবে গাযা - ইসরাইল যুদ্ধ যা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আরো বেশি জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ চাপের মধ্যে ফেলে দেবে । আর এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ও চাপের ( জ্বালানি শক্তি মূল্য বৃদ্ধি চাপ ) কুপ্রভাব ও কুফল প্রকট ভাবে দেখা দেবে।